চারের দশক এবং সাতের দশক। স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের হৃদয়ে দশকের মাঝখানে বয়ে চলা সময়। সাঁইত্রিশ বছরের রাজনীতি এবং সমাজের আঙ্গিনায় ঘটে যাওয়া বিশৃঙ্খলার আখ্যান এই বই। কিংবা সময়ের এক সমান্তরাল কাহিনী। কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কেউ কেউ চেনা। কেউ বা আবছায়ায় অচেনা। কারোর কারোর গল্প সময়ের সীমা পেরিয়ে দিব্যি বেঁচে আছে কলকাতার অলিতে গলিতে। এই বই সেই সব মৌখিক ইতিহাসকে ধরে রাখতে চেয়েছে অক্ষর মালায়। স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে ফেরা গল্প, যার সঙ্গে কলকাতা, বাংলা রাজনীতি, সংস্কৃতি, সেলিব্রিটি থেকে প্রভাবশালী নেতা কম বেশি সকলে যুক্ত। এই আখ্যান প্রকাশ্য কলকাতার সমান্তরালে গোপনে হেঁটে যাওয়া এক কলকাতার গল্পও বটে। এখন কলকাতা শহরে মস্তান নেই। নাকি আরো বেশি কিছু আছে! এই নিয়ে তর্ক চলুক। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় কলকাতায় সমান্তরাল ক্ষমতার আধার ছিল এই মস্তানতন্ত্র। যা কিনা রাজনীতির সঙ্গে ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। রাজনীতি, জলসা, খেলার মাঠ সর্বত্র ছিল মস্তানদের উপস্থিতি। ক্ষমতার সমান্তরাল আঁধার। হারিয়ে যাওয়ার সময় আর হারিয়ে যাওয়া মস্তানদের কিসসা নিয়ে এই বই। 'মস্তান' শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ 'নেশাগ্রস্তের মত হিতাহিত জ্ঞানশুন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী'। মনে পড়ে যাচ্ছে এক জীবিত মস্তান এই প্রতিবেদককে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন বুঝলেন তো একসময় মারের নেশা চেপে গেল মাথায়। নেশার মতো মারপিট করতাম। আবার অনেক সুফি সাধক নিজের নামের সঙ্গে মস্তান শব্দটি ব্যবহার করতেন ওই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য মত্ত অবস্থায় রূপ তুলে ধরতে। 'রুপ তেরা মাস্তানা' কিশোর কুমারের সেই কালজয়ী গান। ফলে প্রেম, বিশৃঙ্খলা নানাভাবে নানা কিছুতেই মস্তান কথাটা ফিরে ফিরে এসেছে। মানুষ কী বিশৃঙ্খলা ভালোবাসে? সমাজ রাষ্ট্রধর্ম অর্থ অনুশাসনের মাঝখানে পিষ্ট হতে হতে সবাইকে একটু মস্তানি করতে চায়? নিজে যদি করতে না পারে যে করে মনে মনে কি তার অনুরাগী হয়ে ওঠে? একটু তো হয়ে ওঠেই। নাহলে মস্তানদের ঘিরে এমন সাপোর্ট বেস তৈরি হয় কি করে? যে সমর্থন দুর্দিনে মস্তানকে বাঁচায়। অবশ্য সবটা নিছক ভয় বা মুগ্ধতা থেকে নয় এর মধ্যে একটা দেনা পাওনা আছে। বাড়ির আদরের ছেলেকে অনেকেই বলে 'গুন্ডা'। দেখেছো কেমন মস্তান হয়ে উঠেছে! এই বিশৃঙ্খলার প্রতি মানুষের টান মস্তানদের গল্প বাঁচিয়ে রাখে যুগে যুগে লোকের মুখে মুখে। ঈর্ষা,প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিঘাংসা এই সবই তো মানুষের চরিত্র গুণ। কেউ প্রকাশ করতে পারি আবার কারোর ক্ষেত্রে চাপা পড়ে যায়। কিংবা সঠিক শিক্ষা, অনুশাসন একটা মনকে গড়ে তোলে। যেখানে এই বিশৃঙ্খলাকে অসামাজিক মনে হতে থাকে। সামাজিক মানুষের কাছে মস্তানরা সমাজ বিরোধী। সমাজ বিরোধী ছাড়া রাজনীতি কিন্তু চলেনি। সেই স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতি আর মস্তান রাজ পরস্পরের পরিপূরক হয়েছে এই বাংলায়। মস্তানদের দুষ্কর্মের নিয়েই বিস্তৃত হয়েছে রাজনীতি নিশ্চিন্ত আশ্রয়। সেই জায়গা থেকে কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড অবশ্যই রাজনীতির প্রকাশ্য মঞ্চের গোপন গ্রীন রুম। এই বই সেই আখ্যানকেই তুলে ধরতে চেয়েছে। মস্তানদের মস্তান বানালো কারা রাজ্য রাজনীতির কোন কোন অঙ্গুলী হেলনে চলছে মস্তান রাজ এই বই সেই সব দিকেরও সন্ধান করেছে।। এই গ্রন্থে কালিই চেনে কালো কলকাতাকে, কলকাতা আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেতাজ বাদশা, কলকাতার চাইনিজ ডন, থ্রিলার দেখে কিলার, কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান, দ্য ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল, রনি ভানু গ্যাং ওয়ার, শিয়ালদা সরগরম, মস্তান থেকে মন্ত্রী মশাই, রাজনীতিতে রামের উত্থান, বধু বাবু ও কলকাতার মস্তান তন্ত্র, মহানায়কের প্রিয় মস্তান, দক্ষিণ কলকাতার মস্তান রাজ, কলোনিতে কলরব, বাঘাযতীনের কানা অজিত, বিজয়গড়ের নিখিল, মস্তানদের অভিভাবক, মস্তান তন্ত্রে বিভাজন, ফাটা কেষ্ট, মস্তানদের রাজনীতিকরুণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচিত হয়েছে আশা করা যায় গ্রন্থটি দ্রুত পাঠক মহলে বিস্তার লাভ করবে।
কলকাতার তলপেট : মস্তানির একাল সেকাল
Kolkatar Tolpet: Mostanir Ekal Sekal
Kolkatar Tolpet: Mostanir Ekal Sekal - Sourav Guha
সৌরভ গুহ