ভাগীরথী বা হুগলী নদীর পুর্বপাড় বর্তমানের উত্তর চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল খুবই প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত। বরাহনগর থেকে কাঞ্চনপল্লী(বীজপুর) একদা যেমন শিল্প ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল, সাহিত্যসংস্কৃতি,ধর্ম,দর্শন,আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদীধারণা ও বিপ্লবী চেতনায় বিস্তীর্ণ নদীতটসীমা যুগে যুগে আন্দোলিত হয়েছে।
বরাহনগর, আড়িয়াদহ,পেনেটি,সুখচর,খড়দহ, মুলাজোড়,কুমারহট্ট,কাঞ্চনপল্লী ইত্যাদি পুরাতন নামগুলি আজও ঐতিহ্যয়ের কথা স্মরণ করায়। নীলাচল থেকে রামকেলি যাত্রায় চৈতন্যপ্রভুর পদধূলিধন্য বরাহনগর, পেনেটি,কুমারহট্ট(হালিশহর) বৈষ্ণবসাহিত্যে উল্লিখিত। বিংশশতাব্দীর গোড়া থেকে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রেরণায় পানিহাটি-সুখচর, সোদপুর অঞ্চল হয়ে ওঠে কার্পাস বা বস্ত্রশিল্পের উল্লেখযোগ্য স্থান। এছাড়াও কাগজ,সিরামিক,রাসায়নিক,ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে নানা ছোট বড়ো শিল্পের বিকাশ ঘটে গঙ্গাতীরের দীর্ঘ তিরিশ চল্লিশ মাইল জুড়ে। দেশভাগের মধ্যে দিয়ে অঞ্চলের জন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বদলে যায় সামাজিক ভারসাম্য,জমিচরিত্র,প্রাকৃতিক পরিবেশ,জলনিকাশী ব্যবস্থা, লুপ্ত হতে থাকে প্রাণী-পক্ষী ও বৃক্ষাদীর নানা প্রজাতি। মুছে যেতে থাকে ইতিহাসের সাক্ষ্য।
পানিহাটি,সুখচর,সোদপুর অঞ্চলও ছিল বজ্রযানি বৌদ্ধদের তান্ত্রিক সাধনার স্থল। চৈতন্যপ্রভুর উদ্যোগে নিত্যানন্দর আগমনে এইসব "নেড়ানেড়ি" সম্প্রদায় বা নাথযোগীরা বৈষ্ণবে রূপান্তরিত হয় এবং নবদ্বীপের পর পানিহাটি হয়ে ওঠে বৈষ্ণবসংস্কৃতির দ্বিতীয় প্রধান স্থান। আবার শাক্তধর্মেরও একটি ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ আশৈশব জোড়াসাঁকোয় গৃহবন্দি থেকে, জীবনে প্রথম বাহির হয়ে উঠেছিলেন পানিহাটির বাগানবাড়িতে। মহাত্মা গান্ধীর কাছে সবরমতি আশ্রমের পর সোদপুর(খাদি আশ্রম) ছিল দ্বিতীয় আপন নিলয়। পানিহাটির জমিদাররা বর্ধমানের মহারাজার পর সর্বোচ্চ পরিমান খাজনা দিত ব্রিটিশদের। সুখচর ছিল রাধাকান্ত দেব বাহাদুরদের গুরুত্বপূর্ণ জমিদারি এস্টেট। বৃহৎ কুটিরশিল্প হিসেবে লালচিনি উৎপাদিত হত। বাংলায় মোট উৎপাদিত চিনির বড় একটি অংশ সুখচর উৎপাদন করতো। আজও মাটির গভীর থেকে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি, পোড়ামাটি বা পাথরের খননকার্য উঠে আসে। এই অঞ্চলে সোনাই নদী আজ মিথ। আবার আধুনিক পানিহাটিতে জাতীয়তাবোধ থেকে বিভিন্ন মনীষীদের পদার্পন ও প্রেরণায় শিল্পাঞ্চল হিসেবে "প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার" স্বীকৃতি পায় এই অঞ্চল।
আশা করা যায় "কালের কড়চায় বৃহত্তর পানিহাটি" সকল ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাদের কাছে এই বই রত্ন-আকর এবং পানিহাটির সকল জনগণকে নিজের অঞ্চলের ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে।
কালের কড়চায় বৃহত্তর পানিহাটি
Kaler Karchai Brhattara Panihati
Kaler Karchai Brhattara Panihati - Sadhan Chattapadhay
সাধন চট্টোপাধ্যায়