top of page

নিশিকান্তের ডাক - বুদ্ধদেব হালদার

Updated: Mar 31


নিশিকান্ত

বৃষ্টিটা একনাগাড়ে পড়েই চলেছে। অফিস থেকে বেরিয়েছি অনেকক্ষণ। অথচ ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হল। হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল লোকাল ধরে যখন কোননগর স্টেশনে পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত্রি ন'টা ছুঁই-ছুঁই। ইতিমধ্যে দুবার ফোন পেয়েছি নিশিকান্তদার কাছ থেকে। হেঁড়ে গলায় ফোনের ওপার থেকে জানতে চেয়েছে, ‘কখন আসছিস? সময় তো বয়ে যাচ্ছে!’

আমি মৃদুকণ্ঠে হেসে জবাব দিয়েছিলাম, ‘নিশির ডাক যখন পিছনে পড়েছে তখন কি আর না গিয়ে পারি? অপেক্ষা করো, ট্রেন এই উত্তরপাড়ায় ঢুকছে—’

আসলে সপ্তাহের এই একটা দিনের জন্য আমরা চারজন বাকি ছটা দিন সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। শনিবার সন্ধে সাড়ে সাতটা মানেই, আমাদের একমাত্র ঠিকানা—রবিদার চায়ের দোকান। আমাদের চারজনের হাতে চারটে মালাই দেওয়া চা। আর সঙ্গে গরম গরম বেগুনি, আম-আদার চপ কিংবা পাঁপরভাজা। তবে আমাদের আড্ডার মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেন—রাঙাজেঠু। চুয়াত্তর বছরের এই রাশভারী মানুষটি জীবনের নানারকম অভিজ্ঞতায় যেন ঋজু বটগাছের মতন আমাদের মধ্যিখানে বসে থাকেন আর আমরা চারজন, মানে—আমি, নিশিকান্তদা, কৌশিক আর সুদীপ তখন তাঁকে ঘিরে নানারকম প্রশ্নের বান চালাই। তিনি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়ে আমাদেরকে পরাস্ত্র করেন যথারীতি। শুধু তাই নয়, তিনি যখন যে বিষয়ে কথা বলেন, তখন বোঝা যায় সেই বিষয়ের উপর তাঁর গভীর জ্ঞান রয়েছে। হাওয়ায় তিনি কোনো কথাই বলেন না। 

আজ শনিবার। অফিস ছুটি হয়েছে সাড়ে পাঁচটায়। হিসেব মতো পৌনে সাতটার মধ্যেই আড্ডায় উপস্থিত হওয়ার কথা। কিন্তু আবহাওয়া গণ্ডগোলের হওয়ায় রবিদার চায়ের দোকানে পৌঁছতে আমার প্রায় রাত্রি ন-টা পেরিয়ে গেল। গিয়ে দেখি, লোডশেডিং চলছে। আমি আড্ডায় পৌঁছনো মাত্র বৃষ্টির বেগ মুষলধারে বেড়ে গেল। আর ঠিক তখনই সামনে কোথাও বিকট একটা বাজ পড়ল। তার আলোয় ক্ষণিকের জন্য আমার চোখমুখ যেন ধাঁধিয়ে গেল। খানিক পরে সম্বিত ফিরে পেতেই অন্ধকারে অস্পষ্ট সকলকে স্থির বসে থাকতে দেখে বললাম, ‘কেমন বিচ্ছিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে দ্যাখো, থামার নাম নেই একদম। তোমরা সব কখন এলে?’

‘খানিক আগেই এসেছি। আর এসেই এই বিপত্তি।’ সুদীপের গলা পাওয়া গেল। সে অন্ধকারে ঠিক কোথা থেকে কথা বলে উঠল বোঝা গেল না।

আমি দোকানের ভিতরের এককোণে ছোট বেঞ্চিটায় বসে বললাম, ‘আর বলিস না—বিপদ বলে বিপদ—বৃষ্টিতে পুরোই ভিজে গিয়েছি। মোবাইলটাও পাওয়ার অফ হয়ে গেছে।’ অন্ধকারেই গলা চড়িয়ে বললাম, ‘রবিদা, একটা বাতি জ্বালাবে? অন্ধকারে সব ভূতের মতো বসে আছ কেন তোমরা?’

‘কেন? অন্ধকারে ভয় ধরেছে তোর?’ এবারে নিশিকান্তদা খ্যাঁকখ্যাঁক করে চাপাহাসি হেসে উঠল।

আমি কিছু বলার আগেই রাঙাজেঠু অন্ধকারের ভিতর আবছা মাথা নাড়িয়ে রবিদাকে নির্দেশ করে বললেন, ‘রবি, জলের ঝাঁট আসছে বাবা, দোকানের দরজাটা ভেজিয়ে দে তো। এমনিতেও আজ এই দুর্যোগের রাতে তোর দোকানে কোনো খদ্দের আসবে না। তার ওপর দু-দুটো ট্রান্সফর্মার উড়ে গিয়ে চারদিকে সব কালো কুচকুচে রাত্তির।’

রাঙাজেঠুর কথা শেষ হতেই দেখলাম ঝোড়ো হাওয়ায় দোকানের দরজার পাল্লাদুটো ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। আমি অনেকক্ষণ ধরে কেমন একটা পোড়া-পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। সেকথা জিগ্যেস করতে যাওয়ার আগেই রবিদা আঁধার হাতড়ে আমার হাতে একভাঁড় গরম মালাই চা দিয়ে গেল। অস্ফুটে বলে গেল, ‘আজ অন্ধকারেই আড্ডা হবে। আলো জ্বালানো হবে না। আমরা সকলে তা-ই চাই। তুমি?’

আমি গরম চায়ে চুমুক দিয়ে একটা আরামসূচক শব্দ করে বললাম, ‘যা খুশি করো গে তোমরা, এই যে আমি পা গুটিয়ে বাবু হয়ে বসলুম বেঞ্চিতে, এবারে আড্ডা শুরু হোক—’

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিশিকান্তদা সর্দিধরা গলায় বলল, ‘তুই যে তখন বললি নিশিডাকে পেয়েছে তোকে, তা এই ঘন নিশি কেমন লাগছে এখন?’

আমি হো-হো করে হেসে উঠে বললাম, ‘কথাটা ধরে নিয়ে বসে রয়েছ দেখছি এখনও! এসব ছেলেবেলায় ঠাকুমার মুখে গ্রাম্য গালগল্পে শুনেছিলাম একসময়। আদতে ওসব তখনকার চোর ছ্যাঁচড়দের বুজরুকি ছাড়া আর কিছু নয়।’

রাঙাজেঠু বার দুই কেশে উঠলেন। আমার কথায় কেউ কোনো প্রত্যুত্তর করল না। অন্ধকারে সব আবছা মূর্তি হয়ে প্রত্যেকেই যেন নিস্পন্দ হয়ে রয়েছে।

ক্ষণ মুহুর্ত এরকম চুপচাপ কাটার পর রাঙাজেঠুর খসখসে গলা পাওয়া গেল। তিনি সংক্ষেপে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘বুজরুকি নয়।’

নিশিকান্তদার গলা পাওয়া গেল এবার। সে কোনো গৌরচন্দ্রিকা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল—‘ঘটনাটা কী? খুলেই বলুন না।’

আসা অবধি কৌশিককে চুপচাপ থাকতে দেখেছি। এতক্ষণে সেও অন্ধকারের মধ্যে বলে উঠল, ‘নিশির ডাকেই তো সুব্রত পায়ে পায়ে এখানে পৌঁছল, আর এসেই ঘটাল বিপদ—।’ বলেই সে হেসে উঠল ফিক করে। আমার নাম ধরে বলায় আমি আবারও জোর গলায় বললাম, ‘বললাম তো, আমাদের মাতৃভাষায় এই ধরনের অপশব্দের প্রচুর চল। যদিও এসবের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই—’

‘বেশ তো—’ রাঙাজেঠু এবারে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবছা গলায় বললেন, ‘তাহলে একটা ঘটনা বলি শোনো। আমি নিজে সেই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী—’

‘আবার কোন ঘটনা?’ কৌশিক অন্ধকারে ফোড়ন কাটল।

রাঙাজেঠু ওর টিপ্পনিতে পাত্তা না দিয়ে বলতে শুরু করলেন—

“১৯৮৮ সালের ঘটনা। তখন আমি কেবিন কোম্পানিতে চাকরি করি। বয়স অল্প। ফলে গায়ে-গতরে খেটে খুব কম সময়েই ম্যানেজারের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলুম। শুধু যে প্রিয় তা নয়—পরে তা বন্ধুত্ব—এবং বন্ধুত্ব থেকে আত্মীয়তা তৈরি হয়। সেসব অনেক পরের ঘটনা যদিও।  

ব্রাহ্মণের ছেলে হওয়ায় আমি চাকরি-বাকরির বাইরেও পুজো-আচ্চা, বাস্তু পুরোজ্য, শ্রাদ্ধযজ্ঞাদি এইসব করে বেড়াতুম। খুব যে উপার্জন হত তা নয়। তখন তো আর পুজোআচ্চা নিয়ে আজকের মতো দিকে দিকে এত ব্যবসা গড়ে ওঠেনি। এলাকায় আমার বাবা যেহেতু নামি পূজারি হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন, তাই তিনি চাইতেন—তাঁর ছেলে হওয়ার সুবাদে আমিও যেন ওনার মতো ঠাকুর-দেবতার পুজো আচ্চা করে বেড়াই। কিন্তু আমার মনে হত, ওভাবে বাবার পথে চললে পরবর্তীতে পেটে ভাত জুটবে না। একটা চাকরি-বাকরি না থাকলে বিয়ে-থা করে মুশকিলে পড়ব। তাই চাকরি জুটিয়ে নিয়ে লেগে পড়লুম। আর বাবার মান রাখার জন্য অবসরে পুরোহিতগিরি করতুম। তবে যেটুকু করতুম—সবটাই আরাধ্যকে তুষ্ট করার জন্য, এর বাইরে আমার আলাদা কোনো চাহিদা বা উদ্দেশ্য ছিল না—। এভাবে দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিল। এমন সময় ঘটল সেই ঘটনা—’

‘ঘটনা! কী ঘটনা?’ নিশিদা অন্ধকারে ফিসফিসিয়ে উঠল। 

আমরা সকলে গল্পে বুঁদ হতে শুরু করেছি। তাই, আমাদের কারোর মুখে কোনো কথা নেই। রাঙাজেঠু নিশিদার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আবারও বলা শুরু করলেন—

‘কয়েক সপ্তাহ ধরেই লক্ষ করছিলাম আমাদের ম্যানেজার কেমন মনমরা হয়ে থাকেন আজকাল। কাজে তেমন মন নেই। দুচোখে যেন কেমন দুশ্চিন্তার মেঘ। সবসময় যেন একটা ভয় তাকে ঘিরে রেখেছে। একদিন নিজের ঘরে একা একা টেবিলে মাথা গুঁজে তাকে কাঁদতে দেখে আমি আর সঙ্কোচ না করে সরাসরি তার কাছে গিয়ে বললাম—স্যার, আপনি কি কোনো বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত?

আমার কথা শুনে তিনি ধীরেসুস্থে মুখ তুলে তাকালেন। কিন্তু নিজের চোখের জলটুকুও আর আড়াল করার কথা ভাবলেন না। হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছে ইশারায় সামনের চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন। এতটা আমি আশা করিনি যদিও। তবুও মনে হল তিনি আমাকে বেশ ভরসা করেন। তাই নিজের মনের অস্থির অবস্থাটা বিন্দুমাত্র লুকোবার চেষ্টা না করে খুব মৃদুকণ্ঠে বললেন, আসলে আমার ছেলেটা খুব অসুস্থ।

—সে কী! কী হয়েছে আপনার ছেলের?

আবারও তেমনই শান্ত কণ্ঠে মাথা নাড়িয়ে বললেন, কী হয়েছে বুঝতে পারছি না।

আমি আমতা আমতা করে বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে কি খুলে বলা যায় ব্যাপারটা?

কথা শুনে তিনি থম মেরে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। মনে মনে কী ভবলেন কিছুই বোঝা গেল না। তারপর তেমনই শান্তভাবে উত্তর দিলেন, গত তিনমাস ধরে আমার ছেলের অসুখ কিছুতেই সারছে না। 

—কী অসুখ আপনার ছেলের?

—সেটাই তো বুঝতে পারছে না কেউ। শহরের এতগুলো নামিদামি ডাক্তার দেখালাম। তবুও—সেই একই অবস্থা। কেউ কিছু বলতে পারে না। তিনমাস ধরে যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে ছেলেটা। একা একা রাতদিন নিজের ঘরে বসে বিড়বিড় করে চলেছে। মুখে নিজস্ব কোনো বোল নেই। বাড়ির কারোর সঙ্গে কোনো কথা নেই। দৃষ্টি বিনিময় নেই। যেন আমাদের কাউকে চেনেই না সে। ওর চিন্তায় চিন্তায় আমার গৃহিণীও যেন শেষ হয়ে যাচ্ছেন। বাবা, মা কোনোমতে সংসারের হালটুকু ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গোটা বাড়িতে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

ম্যানেজারের কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ছেলের বয়েস কত?

তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—পনেরো।

আমি বললাম, ডাক্তার কিছু বুঝতে পারছেন না?

—যতজনকে দেখিয়েছি প্রত্যেকেই বলেছে আপনার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ। ওর কোনো অসুখ নেই।

—তাহলে একটা সুস্থসবল ছেলে হঠাৎ বোবা হয়ে যাবে কেন?

—আমারও তো সেটাই প্রশ্ন!

ওনার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। খানিকক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর মুখে আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে উঠে পড়লাম। তিনিও আর কিছু বললেন না। আগের মতোই চুপচাপ বসে রইলেন একা।

 


 

        

বাড়িতে ফিরে রাত্রে খেতে বসে মা-বাবার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে আমাদের ম্যানেজারবাবুর ছেলের কথাটা বললাম। আমার কথা শুনে বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন, সে কী রে? ডাক্তার কিছু ধরতে পারছেন না?

—না।

খেয়েদেয়ে যে যার উঠে গিয়ে শোবার ব্যবস্থা করছি। মা আর বাবা ভিতরের ঘরে ঘুমোন। আমি বারান্দাতে জানলার ধারের একটা চৌকিতে শুই। মশারি টাঙিয়ে শোওয়ার তোড়জোড় করছি এমন সময় বাবা ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে বললেন, খোকা শোন।

আমি বাবার ডাকে মশারি ফেলে চৌকি থেকে নেমে এসে বললাম, কিছু বলছ?

—হ্যাঁ, ওই তোর ম্যানেজারের ছেলের ব্যপারটা নিয়ে..

আমি বাবার মুখের দিকে তাকালাম—অভিজ্ঞ মানুষ। কথাটা যখন তাঁর কানে গেছে নিশ্চয়ই কিছু একটা আন্দাজ করেছেন তিনি। এমনি এমনি তো আর লোকে বাবাকে খাতির করে না! ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি তাঁকে। খুবই গুণী মানুষ একজন।

জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বুঝতে পারলে?

বাবা বললেন, তোর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করবি তার ছেলেটা নিজের গা থেকে কোনো বিকট পচা গন্ধ পাচ্ছে কি না? গন্ধটা ওর ছেলে ছাড়া আর কারোর নাকে আসবে না।

আমি সামান্য আশ্চর্য হয়ে মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক আছে।

পরের দিন অফিসে পৌঁছে সোজা ম্যানেজারের ঘরে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, স্যার—আপনার ছেলে কি নিজের গা থেকে কোনো দুর্গিন্ধ পাচ্ছে?

    আমার কথা শুনে ম্যানেজার অবাক হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

    মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ—সারাদিন বিড়বিড় করে সে তার গা থেকে বেরনো পচা গন্ধের কথাই বলে। আমরা তার মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শুনেছি। এছাড়া তার মুখে আর অন্য কোনো বোল নেই। 

    একটু থেমে বললেন, কিন্তু-কিন্তু এসব তুমি জানলে কী করে রথীন?

    আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তাকে সোজা বাবার কাছে নিয়ে এলাম। বাবা ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে কথা বলে কিছু একটা ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর একটা চিরকুট লিখে তার হাতে দিয়ে বললেন—আপনার ছেলেকে কোনো অশুভশক্তিতে পেয়েছে, ডাক্তারে কিছু হবে না মশাই। এই কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়েছি, তান্ত্রিক গুরু কৃপাচার্য মহারাজের কাছে একবার ঘুরে আসুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস হারাবেন না। সব ঠিক হবে।

    কথা থামিয়ে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—খোকা, তুই ওনার সঙ্গে যাস। ওনাকে সাহায্য করিস। এই খারাপ সময়ে একা ছাড়িস না যেন ওনাকে।

 

 

         

পাণ্ডুয়ার লাহা পাড়ায় কৃপাচার্য মহারাজকে চেনেন না এমন কেউ নেই বোধয়। স্টেশনে নেমে জিজ্ঞেস করে আমরা গুরুদেবের বাড়ি ঠিক পৌঁছতে পেরেছি। ম্যানেজারবাবু ও তার ছেলের সঙ্গে আমিও এসেছি। অ্যাকে তো খোদ ম্যানেজারবাবুই আমাকে ছাড়তে চাইছেন না। তার ওপর বাবার নির্দেশ রয়েছে। কাজেই তাদের এই দুঃসময়ে সামান্য উপকারেও যদি পাশে থাকতে পারি, তা আমারই সৌভাগ্য। আমরা গুরুদেবের বাড়িতে পৌঁছে গেছি সেই সকাল এগারোটায়। গিয়ে বৈঠকখানায় বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করছি। ইতিমধ্যে আমাদেরকে ভিতর থেকে জলখাবার দেওয়া হয়েছে। বসে রয়েছি তিনজনে। বাবার হাতে লেখা সেই চিরকুট ভৃত্য মারফৎ পৌঁছে দিয়েছি বাড়ির অন্দরে। বসে বসে কেমন একটা ঝিমুনি ভাব চলে এসেছিল, হঠাৎ একটা গম্ভীর ভারী গলার শব্দে নড়েচড়ে বসলাম। দেখি, একজন দশাসই চেহারার মানুষ ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর গলায় অজস্র রুদ্রাক্ষের মালা। আর চুলে জটা রয়েছে। বয়েস আন্দাজ ষাটের উপর। পরনে লালবস্ত্র। ললাটে রক্তচন্দনের প্রলেপ। তিনি ঘরে ঢুকেই ম্যানেজারবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর ছেলেকে নিশিডাকে পেয়েছে। পারবারিক শত্রুতায় তোর নিজের কেউ এই অঘটন ঘটিয়েছে।

    —গুরুদেব, আমাকে বাঁচান। এই বিপদে আমি আপনার আশ্রয় নিয়েছি। কোথায় যাব, কার কাছে যাব, আমাকে বাঁচান আপনি।

    ম্যানেজারবাবু প্রায় হাতেপায়ে ধরার মতো করে কেঁদে ফেললেন। আমি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমি কিছু বলার আগেই কৃপাচার্য গুরুদেব বললেন, প্রবীরদাকে আমি সম্মান করি। তিনি আমার প্রিয় মানুষ। তিনি যখন আপনাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তখন আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।

    বুঝলাম উনি আমার বাবার কথা বলছেন। তাই, তাঁর কথার সূত্র ধরে বললাম, আমার নাম রথীন ভটচাজ। আমি প্রবীর ভটচাযের একমাত্র পুত্র। কথা শেষ না করেই তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, মঙ্গল হোক। 

    কৃপাচার্য গুরুদেব ম্যানেজারবাবুর ছেলেটির মাথায় রক্তজবা ছুঁইয়ে বললেন, এই অমাবস্যায় ওষুধ তুলতে হবে। নাহলে আপনার ছেলে কোনো অবস্থাতেই আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে না। ওর মুখের বোল কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

    —যা করতে হয় করুন গুরুদেব। আমার ছেলেটিকে বাঁচান। এবারে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললেন আমাদের ম্যানেজারবাবু।

    গুরুদেব তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনদিন পরেই ঘোর অমাবস্যা। আমদেরকে যেতে হবে বিষ্ণুপুরের মহাশ্মশানে। সেখানে প্রেতআহ্বান করেই পাওয়া যাবে এই ওষুধ। 

    —শ্মশানে!

    —হ্যাঁ। তবে…। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আমার সমভিব্যাহারী রূপে তোমাকে চাই রথীন।

    —আমাকে! ভয়ে ভয়ে বললাম, গুরুদেব আমি তো গুপ্তবিদ্যা কিছুই জানি না।

    —তুমি লক্ষণ যুক্ত। তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার প্রয়োজন রয়েছে।

    —বেশ, গুরুদেব।

    আমরা কেউ আর কথা বাড়ালাম না। ফিরে এলাম সেদিন। 

 

 

 

বিষ্ণুপুর মহাশ্মশান। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি সুপ্রাচীন জাগ্রত পবিত্র দাহভূমি। চারদিকে মরা পোড়ানো ছাইয়ের স্তূপ। কাছেপিঠে এখনও দু-একটা চিতায় আগুন আছে। মানুষজন কেউ কোথাও নেই। আশেপাশে বড় বড় অশ্বথ, বট, পাকুড় আর কদমগাছ রয়েছে। চারপাশে জঙ্গল, ধু ধু দিগন্ত মাঠ আর ধানজমি, খালবিল। শ্মশানে শিয়ালের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় বড় কুকুরের দলও রয়েছে। ভয়ঙ্কর এক পরিবেশ।

    কথা মতো মহারাজের সঙ্গে আমি বিষ্ণুপুরের মহাশ্মশানে এসেছি। এসে অবধি ভয়ে সিঁটিয়ে আছি আমি। আগে জানলে দশবার ভেবে দেখতুম। পরের উপকারের চেয়ে নিজের জানটা বাঁচলেই হয় এবার।

    চারদিকে অন্ধকার থিকথিক করছে। সামান্য দূরত্বেও একে অপরকে দেখা যায় না। তার মধ্যে শিয়ালের ডাক আর অমঙ্গলসূচক সারমেয় কান্নার শব্দ যুগপৎ মনে ভয়ের কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে বারবার। এই শ্মশানেই নাকি কৃপাচার্য গুরুদেব গূঢ় সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তাই, এই মহাশ্মশানই ওষুধ তোলার জন্য তাঁর প্রথম পছন্দ। 

    শ্মশানের পূর্বকোনে মরা পোড়ানো ছাইয়ের স্তূপ উঁচু ঢিবি হয়ে আছে। সেখানে উঠে তিনি প্রথমে গণ্ডি কেটে দিলেন। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ এই রাত্রে এই পবিত্র শ্মশানভূমিতে যা-ই ঘটনাই ঘটুক, এই গণ্ডি ছেড়ে তুমি কখনোই বেরিও না। যদি ভুলেও এই গণ্ডি অতিক্রম করো তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনো।

মহারাজের কথা শুনে ভয়ে আমার নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়।

    তিনি অন্ধকারে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছেন—

    তেত্রিশ কোটী দেবতা ছয়কোটী দানা।

    বন্দন টুটিলে পরে লাগিবেরে হানা।।

    আসন পেতে আমরা দুজনে পাশাপাশি বসলাম। তিনি ছাইয়ের স্তূপের পাহাড়ের উপর গণ্ডির মধ্যে একটা ষটচক্র আঁকলেন। বিভিন্ন রঙের আবির দিয়ে প্রথমে ষটকোণ, তারপর বৃত্ত, শেষে অষ্টপদ্ম করলেন। এরপর নিজের ঝোলা থেকে একটি করোটি বের করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই খর্পরে কীভাবে মহাকালীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় জান?

আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বললাম।

    —খর্পরটিকে শোধন করে পবিত্র গঙ্গার জলে ধুয়ে নিতে হয়। তারপর ঘি-মধু-জবাকুসুম তেল দিয়ে একে ভালো করে মাখাতে হয়। তারপর এটিকে রক্তাভিষেক করে মহাকালীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হয়। সেসব দীর্ঘ সাধনা লাগে। 

    অন্ধকারে দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শিয়ালের ডাক আর আশেপাশের নানারকম উদ্ভট শব্দে মনের জোর তলানিতে এসে ঠেকেছে আমার। প্রেতচক্রের মধ্যে খর্পরটি স্থাপন করে তিনি তার উপর কালীযন্ত্র আঁকলেন। এরপর আমার দিকে ফিরে বললেন, প্রেতের মহাভোগ তৈরি করতে হবে। হাতে হাতে সব এগিয়ে দাও আমাকে।

    আমি পাশে রাখা ব্যাগগুলো একে একে তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি একটি পাত্রে চিরে, খই, বাতাসা, কালোতিল, মাসকলাই, কলা, দই, মধু, মুড়কি একসাথে চটকে মহাভোগ তৈরি করলেন। এরপর ভোগটা পিণ্ডের মতো পাকিয়ে কলার পেটোয় সাজাতে শুরু করলেন। ভোগের উপরে একটুকরো মাছভাজা আর তার ফাঁকে ফাঁকে দিলেন দেশিমদ।     তিনি সবটা সাজিয়ে নিয়ে বললেন, তুমি কী ভাবছ? ভূত এসে গবগব করে এসব খেয়ে চলে যাবে? নিজেই নিজের কথায় হাসলেন। তারপর বললেন, এর যে উর্জা তাতেই প্রেত আকর্ষিত হয়। 

    এরপর খানিক চুপ থেকে বললেন, এবারে আমি পুজো শুরু করব। তুমি চুপচাপ বসে থাকবে, আশেপাশে অনেক অবাস্তব ঘটনা ঘটতে থাকবে কিন্তু মনে রেখ ভয় পেলে চলবে না। এই গণ্ডি থেকে তুমি উঠবে না যতক্ষণ না আমি তোমায় বলব।

    ভয়ে আমার গলা থেকে আর স্বর বেরোল না। আমি মাথা নাড়লাম নীরবে।

    হঠাৎ যেন চারদিকে প্রলয় শুরু হল। ইতিমধ্যে গুরুদেব মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করেছেন। তিনি প্রেতআহ্বান করছেন। শ্মশানের অন্ধকারে গভীর রাতে জোরে জোরে তার মন্ত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমাদের চারপাশের গাছপালার ডালপালাগুলো যেন ঝড়ে উথাল-পাতাল খাচ্ছে। অথচ কোথাও কোনো হাওয়া মাত্র নেই। ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। পুজো শুরু করেছেন গুরুদেব। তাঁর মন্ত্রের মধ্যে ম্যানেজারবাবুর ছেলের নাম উচ্চারিত হল বেশ কয়েকবার। বুঝলাম, তার মুক্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনা জানানো হচ্ছে। গুরুদেব মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে মন্ত্র পড়ে চলেছেন। অন্যদিকে নানারকম বিকট শব্দ ও সারমেয় কান্নায় মাথার ভিতরটা টিপটিপ করতে লাগল আমার। কতক্ষণ এমন চলল মনে নেই তবে হঠাৎ আমাদের ঢিবির নীচে সামান্য দূরে একটা দীর্ঘাকার ছায়া দেখতে পেলাম। জ্বলন্ত কয়লার মতো দুটো চোখ। আমার বুকের রক্ত জল হয়ে গেল মুহূর্তেই। আমি সেদিকে স্থির তাকিয়ে রয়েছি, আর ঠিক তখনই গুরুদেবের পিছনে কে যেন জোর ধাক্কা মারল।  কৃপাচার্য মহারাজ হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে গড়িয়ে গেলেন।  তাঁর এই অবস্থা দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু গণ্ডির বাইরে বেরোবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। শরীর অবশ হয়ে গেছে। আমার গলা থেকে আর স্বর বেরোচ্ছে না। হঠাৎ গুরুদেব ঢিবির নীচ থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, পেয়েছি। ওষুধ পেয়েছি। তাঁর গলায় যেন এক আনন্দের স্রোত। সামনে তাকিয়ে দেখি মুহূর্তেই সেই ছায়াটাও অদৃশ্য হয়েছে। গুরুদেব নীচ থেকেই বললেন, নেমে এসো রথীন। আর কোনো ভয় নেই।

    শ্মশানের দক্ষিণে যে মরা গঙ্গার সোঁতা সেখানে গিয়ে গুরুদেবের হাতে ধরা শিকড়খানা ধুয়ে ফেললেন তিনি।

    পরেরদিন আমার মাধ্যমে সেই শিকড় ম্যানেজারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হল। বললে বিশ্বাস করবে না তোমরা বিশেষ আচার মেনে সেই শিকড় বেটে ম্যানেজারের ছেলেকে খাওয়াবার কয়েকঘন্টা পরেই সেই ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। তারপর থেকে আর কখনও কোনো সমস্যা হয়নি ছেলেটার।”

    গল্প শেষ করে রাঙাজেঠু থামলেন। এদিকে আমাদের কারোর মুখে কোনো কথা নেই। যেন আমাদের মাঝে শুধু এক অনন্ত রাত্রি প্রবাহ। কিছুক্ষণ সকলে চুপ করে থাকার পর মনে সংশয় নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করতে গেলাম, ‘কিন্তু..’। আমাকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দিয়ে নিশিকান্তদা অন্ধকারের ভিতর বলে উঠল, ‘নিশিডাকের আরও বড় প্রমাণ চাই তাই তো?’ এমন সময় হঠাৎ বাইরে থেকে একটা হইচই কানে এল। বেশ কিছু লোকের জটলা। আস্তে আস্তে লোকগুলো এগিয়ে এসে দোকানের ভেজানো পাল্লাটা ঠেলে খুলে দিল। কয়েকটা টর্চের অসহ্য আলোয় আমাদের চোখ ধাধিয়ে গেল। লোকগুলো সকলেই মেঝের দিকে তাকিয়ে কেমন ভীত সন্ত্রস্ত চোখে দাঁড়িয়ে পড়ল। কে যেন ভিড়ের আড়াল থেকে মৃদুস্বরে বলল, কেউই তো বেঁচে নেই দেখছি। শরীর ঝলসে গেছে সবকটার। বাজ পড়ে কী দূর্ঘটনাই না ঘটে গেল। ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল—দোকানের মেঝেতে একে একে ছড়িয়ে আছে মৃতদেহগুলি—রাঙাজেঠু, নিশিকান্তদা, কৌশিক, সুদীপ, রবিদা...আর ওই যে..ওই যে দূরে..ওটা কে? আমি!

Comentarios

Obtuvo 0 de 5 estrellas.
Aún no hay calificaciones

Agrega una calificación
bottom of page