মন্দির সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস : প্রসঙ্গ রাঢ়বঙ্গ - কৌশিক চন্দ
- কৌশিক চন্দ
- Feb 21
- 6 min read
Updated: Mar 23

মন্দিরময় আমাদের এই বঙ্গদেশ। বঙ্গদেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে অজস্র মন্দির। এগুলির কোনোটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ, কোনোটি তীর্থস্থান রূপে জনসমাজে প্রকাশিত, আবার কোনোটি ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে কালের গহ্বরে নিমজ্জিত। ধর্মীয় স্থান বা প্রতিষ্ঠান রূপে এইসব মন্দিরগুলির পরিচিতি থাকলেও লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে এই মন্দিরগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেইসঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাসের এক অন্যতম উপাদান হিসাবেও স্বীকৃত বাংলার এই মন্দিরগুলি।
লোকসংস্কৃতির পীঠস্থান এই বাংলা। বাংলার গ্রামগুলিতে আজও প্রচলিত আছে প্রাচীন রীতিনীতি, যা এই লোকসংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে প্রতিভাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রীতিনীতিগুলির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে মন্দিরগুলি। মন্দির এবং মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবতা ও দেবীকে উদ্দেশ্য করে নিবেদিত এই প্রাচীন রীতিগুলি আবার স্থান বৈচিত্র্যে সমুজ্জ্বল। তাই আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতায় এই মন্দির সংস্কৃতির একটি বিশেষ ভূমিকা আছে বলেই মনে করি।
আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে মন্দির সংস্কৃতি মূলত দুইভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। প্রথম, কোনো মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতার আবির্ভাবের কাহিনী থেকে সেই গ্রাম বা অঞ্চলের উৎপত্তির ইতিহাস এবং তা থেকে আঞ্চলিক ইতিহাসের সৃষ্টি। এক্ষেত্রে দেবতার নামের সাথে সাজুয্য রেখেই গ্রামটির নামকরণ হয়ে থাকে। আর অপরটি হল গ্রামের অধিষ্ঠিত দেবতার মাহাত্ম্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্থানটির পরিচিতি এবং এই স্থান-মাহাত্ম্যের মধ্যেই সম্পৃক্ত থাকে আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্র। এক্ষেত্রে দেবতার নামের সঙ্গে গ্রামের নামের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।
আমার আলোচনা মূলত রাঢ় বাংলাকে কেন্দ্র করে। এই রাঢ়বঙ্গ বলতে বোঝায় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথীর পশ্চিম কূলের হুগলী, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ ও হাওড়ার কিছু অংশকে। এই রাঢ়ের ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই বিস্তারিত ইতিহাস এ প্রসঙ্গে অপ্রয়োজনীয়। এই আলোচনায় দেখাব আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতায় রাঢ় বাংলার মন্দির সংস্কৃতি কিরূপে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেই বিষয়টি।
রাঢ়বঙ্গের আনাচে-কানাচে রয়েছে অজস্র মন্দির। গ্রামগুলিতে ঘুরে বেড়ালে দেখা যায় প্রায় প্রতি গ্রামেই রয়েছে কোনো না কোনো দেব-দেবীর মন্দির। এই দেব-দেবীরা কোথাও গ্রামদেবতা বা গ্রামদেবী, কখনও বা লৌকিক দেব-দেবীতে পর্যবসিত। গ্রামদেবতারা গ্রাম রক্ষক হিসাবে আজও সুপরিচিত। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট তিথিতে আজও তাদের পূজা হয়। গ্রামদেবতা তথা লোকদেবতা যে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পাতায় কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেই প্রসঙ্গে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিহির চৌধুরী কামিল্যা লিখেছেন, “লোকদেবতারা লৌকিক সমাজের যে মৌনসাক্ষী, এতে আমার এক বিন্দু সন্দেহ নেই। গ্রামীণ মানুষ পুরুষে পুরুষে, বংশপরম্পরায় এঁদের পূজো করে চলেছে। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় বিভিন্ন আকুতি নিয়ে এঁদের কাছে ছুটে গেছে। এঁদের অবলম্বন করে তাদের ভক্তির উচ্ছ্বাস, ভালোবাসার আত্মীয়তাবোধ, কৃচ্ছ্রসাধনার দুরন্ত প্রয়াস। তেমনি এঁদের ঘিরেই মানুষের আনন্দের বিবিধ আয়োজন—পুজো কর্মের বিচিত্র ব্যস্ততা, মেলায় মেলায় আপন সত্তাকে হারিয়ে ফেলা, সাংসারিক প্রয়োজনে কেনাকাটা। এদেশে বারবার সংঘটিত রাজনৈতিক উত্থান পতন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও যুদ্ধ জাতীয় জীবনে নানা প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু এঁদের ঘিরে যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যগুলি সৃষ্ট হয়েছে, সেগুলি রাঢ়ের সামাজিক জীবনে কম প্রভাব ফেলেনি।”
এখানেই আঞ্চলিক ইতিহাসে মন্দির সংস্কৃতির প্রভাবের প্রচ্ছন্ন আভাস পাওয়া যায়। গ্রাম্য সমাজ জীবনে এই মন্দির সংস্কৃতি যে প্রভাব ফেলে, তা থেকেই নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়, সেই সাংস্কৃতিক উপাদানের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য তৈরী করে নতুন আঞ্চলিক ইতিহাস।
তাছাড়া এই গ্রামদেবতা তথা লোকদেবতাদের পূজা ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু প্রাচীন রীতিনীতি, যা আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যে ভূষিত। এই লোকসাংস্কৃতিক উপাদানগুলি বহুক্ষেত্রে আঞ্চলিক ইতিহাসের উপাদান হিসাবেও স্বীকৃত। কোনো অঞ্চলের ইতিহাস তৈরী হয়েছে সেই লোকদেবতা বা লোকদেবীর আবির্ভাব কাহিনী অথবা সেই দেবতা বা দেবীর সঙ্গে জড়িত কোনো উৎসব বা রীতিনীতিকে ঘিরে। রাঢ় বাংলায় এরকম উদাহরণ অজস্র।
রাঢ় বাংলার এই লৌকিক দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন ধর্ম, চণ্ডী, বিশালাক্ষী, শিব, মনসা, কৃষ্ণ এবং কিছু ক্ষেত্রে কালী। এছাড়াও অন্যান্য লোকদেবতা, লোকদেবী ও অপদেবতাদেরও পাওয়া যায়। তবে আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রধান লোকদেবদেবীদের প্রভাব প্রচুর। তাই তাদেরকে ঘিরেই আলোচিত হবে আঞ্চলিক ইতিহাসের কথা।
প্রথমে বলি ধর্মঠাকুরের কথা। ধর্মঠাকুর রাঢ়ের প্রধান দেবতা। রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক ইতিহাসে তাই ধর্মঠাকুরের বিশেষ প্রতিপত্তি লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিভিন্ন নামে পরিচিত। নামের বৈচিত্র্যের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য তাঁকে আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর করে রেখেছে। যেমন বাঁকুড়ারায় ধর্মঠাকুরের নাম থেকে বাঁকুড়া নামের উদ্ভব ঘটেছে বলে শোনা যায়। এক্ষেত্রে বাঁকুড়ার আঞ্চলিক ইতিহাসে তাই এই বাঁকুড়ারায় ধর্মঠাকুরের বিশেষ প্রতিপত্তি পরিলক্ষিত হয়। সেইসঙ্গে বাঁকুড়ারায় ধর্মঠাকুরের অধিষ্ঠানক্ষেত্র ইন্দাসের আঞ্চলিক ইতিহাসও জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়।
কখনও কখনও ধর্মঠাকুরের উৎসবও কোনো অঞ্চলের ইতিহাসকে প্রভাবিত করে। বর্ধমান জেলার জাড়গ্রামের কালুরায় ধর্মঠাকুরের উৎসব এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। কালুরায়ের ‘কামিন্যা সহিত’ ঝাঁপান উৎসবে জাড়গ্রামে বহু মানুষের সমাগম ঘটে। তবে এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মেদিনীপুর জেলাতেও জাড়গ্রাম নামে একটি গ্রামের কালুরায় ধর্মঠাকুরের কথা জানা যায়। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতায় দুটি জাড়গ্রামের উল্লেখ ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে বইকি, এমনকি নতুন গবেষণার ক্ষেত্রও তৈরী করে।
ধর্মের পর এবার আসি চণ্ডীর কথায়। রাঢ় বাংলায় চণ্ডী বিশেষ প্রসিদ্ধ। চণ্ডীর মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত চণ্ডীমঙ্গলের কথা আমাদের সকলেরই জানা। রাঢ়বঙ্গে বিভিন্ন চণ্ডীর নাম পাওয়া যায়। কয়েকজনের কথা বলি। হাওড়া জেলায় আছেন আমতার মেলাইচণ্ডী, মাকড়দহের মাকড়চণ্ডী, বেতোড়ে বেতাইচণ্ডী, বাঁকুড়া জেলায় আছে বৈতলের ঝগড়াইচণ্ডী, হুগলী জেলার চন্দননগরে বোড়াইচণ্ডী দ্বারহাট্টার দ্বারিকাচণ্ডী, চণ্ডীতলার মঙ্গলচণ্ডী প্রভৃতি। এর মধ্যে দেবীর নাম থেকে স্থানের উৎপত্তির ইতিহাসের আভাস পাওয়া যায় মাকড়দহের মাকড়চণ্ডী, বেতোড়ের বেতাইচণ্ডী, বোরো তথা চন্দননগরের বোড়াইচণ্ডী, দ্বারহাট্টার দ্বারিকাচণ্ডীর ক্ষেত্রে। আবার আমতার আঞ্চলিক ইতিহাসে মেলাইচণ্ডীর মন্দিরের প্রভাব অপরিসীম। বাঁকুড়ার বৈতল গ্রামটি প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ঝগড়াইচণ্ডী বা ঝগড়াভঞ্জনী দেবীর অধিষ্ঠান ক্ষেত্র হিসাবে বিশেষ প্রসিদ্ধ। কথিত আছে, এই দেবী দুইজন রাজার (সম্ভবত মল্লভূম ও সামন্তভূমের রাজা) মধ্যে বিবাদ ভঞ্জন করেছিলেন। এখানেই আঞ্চলিক ইতিহাসের সূত্রপাত। লোকশ্রুতি অনুসারে দেবীর আবির্ভাবের অলৌকিক দিকটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হলেও ইতিহাসগত দিক থেকে বিচার করে বলা যায়, এই স্থান দুই রাজার সংঘর্ষের এক অন্যতম ক্ষেত্র।
চণ্ডীর মতোই রাঢ় বাংলার এক বিশেষ প্রসিদ্ধ দেবী হলেন বিশালাক্ষী। চণ্ডী, দুর্গা, কালীর রূপভেদে তিনি পূজিতা। রাঢ়বঙ্গে বিশালাক্ষীর থান প্রচুর এবং সেইসব থান তথা দেবীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে বহু স্থান এমন নিদর্শনও আছে অসংখ্য। যেমন প্রথমেই আসে হুগলী জেলার রাজবলহাটের মা রাজবল্লভীর কথা। দেবী রাজবল্লভীর নাম থেকেই এসেছে রাজবলহাট নামটি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রাজবল্লভীর ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে রাজবলহাটের আঞ্চলিক ইতিহাস। একইভাবে হাওড়ার রতনপুরের রতনমালা দেবীও কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাসের এহেন উদাহরণ।
তবে শুধুমাত্র দেবীর নাম থেকে স্থাননামের উৎপত্তি ও তা থেকে আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতাই নয়, দেবীর থানও অনেকক্ষেত্রে গ্রাম বা স্থানের আঞ্চলিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। যেমন হুগলী জেলার শিয়াখালার উত্তরবাহিনী। এই দেবীর নাম থেকে স্থান-নামটি আসেনি, বরং দেবীর আবির্ভাবের ইতিহাসের সঙ্গে শিয়াখালা গ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে গেছে। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, আনুড়ের বিশালাক্ষী, কাঁঠালীর বিশালাক্ষী, নাইকুলির বিশালাক্ষী প্রভৃতি।
এবার আসা যাক শিবের প্রসঙ্গে। রাঢ়বঙ্গে এমন অজস্র শিব আছে, যার নামের সঙ্গে স্থান নাম মিলে গিয়ে আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। প্রথমেই বলি হুগলীর তারকেশ্বরের তারকনাথের কথা। তারকনাথ শিবের আবির্ভাবের কাহিনীর মধ্যেই আছে তারকেশ্বর অঞ্চলের উৎপত্তির ইতিহাস। একইভাবে বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর, আরামবাগের কাছে কানপুরের কনকেশ্বর, ভদ্রেশ্বরের ভদ্রেশ্বর, ফুলুইয়ের ফুল্লেশ্বর প্রভৃতির নাম করা যায়। তবে শুধুমাত্র শিবমন্দিরের কারণে অঞ্চলের খ্যাতি হয়েছে এবং আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে এমন মন্দিরের সংখ্যাও রাঢ় বাংলায় কম নয়। তারাহাটের তারকনাথ, শিহড়ের শান্তিনাথ, মহানাদের জটেশ্বরনাথ, খানাকুলের ঘন্টেশ্বর, বালীর কল্যানেশ্বর প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখের দাবী রাখে। এই মন্দিরগুলি নিজ মাহাত্ম্যে এতটাই সমুজ্জ্বল যে আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতায় এদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা যায়।
রাঢ়বঙ্গের অপর উল্লেখযোগ্য দেবী হলেন মনসা। মনসার পৃথক মন্দির খুব কম স্থানেই আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি হয় ধর্মঠাকুরের কামিন্যা, নতুবা কোনো থানে পূজিতা। আঞ্চলিক ইতিহাসে মনসা মন্দির উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে এমন একটি মন্দিরের কথাই বলা যায়, তা হল নারিকেলডাঙার জগৎগৌরী মন্দির। কথিত আছে, এই স্থানে বেহুলা মনসাকে নারিকেল ভেঙে বা নারিকেল দিয়ে পূজা করেছিলেন বলে স্থানের নাম হয়েছে নারিকেলডাঙা।
রাঢ় বাংলায় কৃষ্ণ মন্দির বেশিরভাগই বৈষ্ণব শ্রীপাট হিসাবে গড়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে বলা যায়, স্থানগুলি পূর্বেই ছিল এবং স্থানগুলিতে চৈতন্যযুগে বা চৈতন্য পরবর্তীকালে শ্রীপাট তথা মন্দির গড়ে ওঠে। বরং বলা যায়, কোনো না কোনো বৈষ্ণব পরিকরের বসবাস এবং তাঁর সেবিত বিগ্রহকে ঘিরেই গড়ে উঠত শ্রীপাট। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্র যে প্রস্তুত হত না, তা নয়। তবে দেবতার নাম থেকে কোনো অঞ্চলের ইতিহাস তৈরী হয়েছে, এমন উদাহরণ বলা যায় খানাকুল কৃষ্ণনগরের অভিরাম গোস্বামী সেবিত গোপীনাথ কৃষ্ণের মন্দির। অনেকেই মনে করেন, খানাকুল কৃষ্ণনগরের গোপীনাথ কৃষ্ণের বিগ্রহের হেতু সেই গ্রামের নাম খানাকুল হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপীনাথ মন্দিরের পাশেই অবস্থিত রাধাকান্ত মন্দিরের কারণেই খানাকুলের এই স্থান খানাকুল কৃষ্ণনগর নামে পরিচিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে বিস্তারিত ইতিহাস সৃষ্টির কাজ ভবিষ্যৎ গবেষকদের উপরই ছেড়ে দিলাম।
বাংলার অন্যান্য দেবদেবীরাও যে আঞ্চলিক ইতিহাসের উপাদান হিসাবে নিজেদের প্রস্তুত করেছে, এমন উদাহরণও কম নয়। তিরোলের খ্যাতি ক্ষ্যাপাকালীর জন্য, ফুলুই জয়দুর্গার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। এছাড়াও আছে বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা, কাঞ্চননগরের কঙ্কালেশ্বরী, জড়ুরের ভগবতী, বেঙ্গাঈয়ের মহাকালী, সিঙ্গুরের ডাকাতকালী প্রভৃতি। মন্দিরগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে আছে আঞ্চলিক ইতিহাস।
অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, দেবমন্দিরগুলির সঙ্গে যুক্ত কাহিনীগুলি তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকশ্রুতি ও জনশ্রুতি নির্ভর। তাহলে এগুলি কীভাবে ইতিহাসের উপাদান রূপে স্বীকৃত হতে পারে? এর উত্তরে বলব, জনশ্রুতি ও লোকশ্রুতির মধ্যে অনেক অলৌকিক, আজগুবি কথা বলা হলেও কিছু কিছু ঐতিহাসিক উপাদান প্রচ্ছন্নভাবে থাকে। সেই ঐতিহাসিক উপাদানটিকেই অনুসন্ধান করে যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করাই ঐতিহাসিকের কাজ। একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে বিষয়টি। ধরা যাক তারকেশ্বরের তারকনাথের কথা। কথিত আছে, তিনি স্বয়ম্ভূ। মুকুন্দ গোয়ালার দ্বারা প্রকাশিত। রামনগরের রাজা রায়ভারামল্ল স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে তারকনাথ শিবের মন্দির নির্মাণ করে দেন। এরপর থেকেই স্থানটির নাম হয় তারকেশ্বর এবং কালক্রমে তীর্থ হিসাবে প্রসিদ্ধ হয়। এই কাহিনী যথেষ্ট অলৌকিকতার দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু কাহিনীটির মধ্যেই তারকেশ্বর অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস নিহিত। রাজা রায়ভারামল্লও কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন, বরং ইতিহাস স্বীকৃত। এছাড়াও তারকেশ্বর নিয়ে লেখা বেশ কিছু গ্রন্থ থেকে এখানে দশনামী গিরি সন্ন্যাসীদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সুতরাং তারকেশ্বর অঞ্চলের ইতিহাসে দশনামী সন্ন্যাসীদের একটা বিশেষ প্রভাব আছে। অলৌকিকতাকে দূরে সরিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ প্রমাণ সহকারে তারকেশ্বর অঞ্চলের দশনামী সন্ন্যাসী ও রাজা রায়ভারামল্লের কীর্তিকে তুলে ধরে আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্রটিকেই প্রতিষ্ঠা করা ইতিহাস গবেষকের কাজ।
শেষের কথায় বলি, বর্তমান রাঢ় বাংলার মন্দির সংস্কৃতি নিয়ে অজস্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বর্ধমানের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, মল্লভূম বিষ্ণুপুরের ইতিহাস লিখেছেন মনোরঞ্জন চন্দ্র, হুগলী ইতিহাসের ওপর আছে সুধীর কুমার মিত্রের হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ। গ্রন্থগুলিতে মন্দির সংস্কৃতি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু মন্দির সংস্কৃতির সঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাসের যে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, তা কিন্তু তুলে ধরা হয়নি। মন্দিরময় মল্লভূম বিষ্ণুপুরকে নিয়ে রয়েছে অজস্র কাজ। বেশিরভাগ কাজই মন্দির লেখ, প্রাপ্ত শিলালিপির বিশ্লেষণ প্রভৃতি কাজকে তুলে ধরে। খুব সামান্যভাবে বলা থাকে মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট। কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাসের উপাদান যে গল্পগুলি, সেগুলিকে এড়িয়ে যান বেশিরভাগ ইতিহাসবিদই। কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাসের আসল উপাদান সেই জনশ্রুতি বা লোকশ্রুতিমূলক কাহিনীই। এগুলিই সমৃদ্ধ করে তোলে আঞ্চলিক ইতিহাসকে। নতুন নতুন অজানা ইতিহাস প্রকাশিত হয়। তবে এইধরণের আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে যে কাজ হয় না এমন নয়। স্থানীয় কোনো ব্যক্তি নিজ উদ্যোগেই হয়ত লিখে ফেলেন একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা। তাতে হয়ত ইতিহাস সচেতন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না, কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাসের একটি ক্ষেত্র এর মধ্য দিয়েই তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু প্রচারের অভাবে তা হয়ত পৌঁছাতে পারে না আপামর জনসাধারণের কাছে। তাই সবশেষে বলি, এই দিকটির দিকে নজর দিলে হয়ত আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা আরও সমৃদ্ধ হবে, সমৃদ্ধ হবে বাঙালির সংস্কৃতি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ফুটে উঠবে বাঙালির কীর্তিগৌরব।
খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটি